হোম / যিলহজ্ব ঈদুল আযহা কুরবানী: ফাযায়েল ও মাসায়েল / ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস; জাল বর্ণনা থেকে বাচুন!

ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস; জাল বর্ণনা থেকে বাচুন!

ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস

ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক রকমের জাল বর্ণনা পাওয়া যায়। সহিহ্ ইতিহাস অনেক মানুষই জানে না। তাই এখানে প্রথমে কুরআনের আলোকে ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির সঠিক ইতিহাস তুলে ধরব। তারপর কিছু জাল বর্ণনা উল্লেখ করে আমরা তা সতর্ক হবো -ইনশাআল্লাহ্।

কুরআন মাজীদের সূরা সফফাতের ১০২ থেকে ১০৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْىَ قَالَ يٰبُنَىَّ إِنِّىٓ أَرٰى فِى الْمَنَامِ أَنِّىٓ أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرٰى ۚ قَالَ يٰٓأَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِىٓ إِن شَآءَ اللَّهُ مِنَ الصّٰبِرِينَ

অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কী? সে বললঃ পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।

فَلَمَّآ أَسْلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلْجَبِينِ

অতঃপর যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শোয়ালেন,

وَنٰدَيْنٰهُ أَن يٰٓإِبْرٰهِيمُ

তখন আমি তাকে ডেকে বলামঃ হে ইব্রাহীম!

قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْيَآ ۚ إِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِينَ

তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে প্রমাণ করলে। আমি এরূপেই খাঁটি বান্দাদেরকে পুরস্কার দিয়ে থাকি।

إِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓؤُا الْمُبِينُ

নিশ্চয়ই এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

وَفَدَيْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ

আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান জবেহ  এর বিনিময়ে। -সূরা সফফাত, আয়াত ১০২-১০৭।

কুরআনের আলোকে ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম :

১. আয়াতে হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর বয়স কত ছিল তা বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, ‘অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল’। বয়স কত হয়েছিল সে সম্পর্কে কোন হাদীস পাওয়া যায় না। সম্ভবত: মুফাসসিরিনে কেরাম আয়াতের পূর্বোক্ত অংশ থেকে আনুমানিক একটা বয়সের কথা বলেছেন। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ হলো, ১৩-১৬ বছর।

২. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বপ্নে সরাসরি তার সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কে যবেহ্ করতে দেখেছেন। তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু যবেহ করতে দেখেননি।

৩. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সরাসরি তার সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর কাছে তার মতামত জানতে চেয়েছেন। এমন নয় যে, তাকে যবেহ এর কোন কথা না বলেই তাকে যবেহ করতে নিয়ে গেছেন। বা তাকে যবেহ করতে নেওয়ার সময় যবেহের বিষয়টি তার থেকে গোপন রেখেছেন।

এখান থেকে আরো একটি বিষয় বুঝে আসে যে, ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর বয়স ১৩-১৬ এর মধ্যেই হবে। কারণ, মতামত দেওয়ার মত বয়স না হলে মতামত চাওয়ার কোন অর্থ হয় না। আর সাধারণত না বালেগ বাচ্চার পক্ষ থেকে কোন মতামত নেওয়াও হয় না।

৪. ইসমাঈল আলাইহিস সালাম যবেহের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ মতামত দিয়েছেন এবং পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং এও বলেছেন যে, তিনি সবরের পরিচয় দিবেন।

৫. অতঃপর যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শোয়ালেন, তখন আমি তাকে ডেকে বলামঃ হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে প্রমাণ করলে। আমি এরূপেই খাঁটি বান্দাদেরকে পুরস্কার দিয়ে থাকি।

এখান থেকে বুঝা যায়, যবেহ এর আগে পিতা-পুত্র উভয়েই যবেহের ব্যাপারে একমত হয়েছেন এবং আল্লাহর হুকুম মেনে নিয়েছেন। আরেকটি বিষয় হলো, ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাত করে শোয়ালেন তখনই আল্লাহ্ ডাক দেন…..! এখান থেকে সুষ্পষ্ট যে, তিনি ছুরি চালাননি এবং রগ কাটা না কাটার কোন ঘটনাও ঘটেনি।

৬. আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক বড় জবেহ এর বিনিময়ে। এখানে সুস্পষ্টভাবে শুধু একটি জবেহ এর কথা রয়েছে। মুফাসসিরীনে কেরামের বক্তব্য থেকে জানা যায় এটি দুম্বা ছিল। কিন্তু এটি হাবিলের দুম্বা কি না তার কোন বর্ণনা কুরআনে তো নেই, হাদীসেও নেই।

ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস নিয়ে জাল বর্ণনা

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কে স্বপ্নে দেখানো হলো ‘তোমার প্রিয় বস্তুকে কুরবানী কর’। তখন তিনি ১০০ উট কুরবানি করলেন। আবার একই স্বপ্ন দেখানো হলে তিনি ১০০ দুম্বা কুরবানী করলেন। আবারও একই স্বপ্ন দেখানো হলে তিনি গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখলেন তার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে তার সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালাম।

তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার স্ত্রী হাজেরাকে আলাইহিস সালাম বললেন ছেলেকে গোসল করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়ার জন্য। বললেন, তিনি ছেলেকে নিয়ে দাওয়াত খেতে যাবেন। জবাইয়ের আগে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তার পিতা হযরত ইবরাহীমকে বলেন, তিনি যেন তাকে শক্ত করে বেধে নেন। যেন বাবার গায়ে হাত পা ছুটাছুটির সময় পা লেগে না যায়।

আর তার রক্তে মাখা জামা-কাপড়গুলো যেন তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। যেন তার মা কাপড়গুলো নিয়ে সান্ত্বনা পান। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম আরো বলেন তাকে কাত করে শোয়াতে। যেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার চেহারা দেখে মায়ার বশবর্তী হয়ে কুরবানী করা থেকে বিরত না হন। বলা হয় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বারবার ছুরি চালাচ্ছিলেন কিন্তু কিছুতেই জবাই হচ্ছিল না। ইত্যাদি… ইত্যাদি… ইত্যাদি…

ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস নিয়ে জাল বর্ণনাগুলো নিম্নরুপ :

পূর্বোক্ত গল্প থেকে যে বিষয়গুলো আমরা শুনে থাকি কিংবা বলে বেড়াই অথবা আমাদের ওয়ায়েজীনে কেরাম বলে থাকেন তাই এই :

১. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কে স্বপ্নে তাঁর প্রিয় বস্তু কুরবানী করতে বলা হয়। অথচ আয়াত বলছে, তিনি তার সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কে যবেহ করতে দেখেন।

২. প্রিয় বস্তু কুরবানী করার স্বপ্ন তিনি পর পর তিন দিন দেখেন।

৩. স্বপ্নের প্রথম দিন ১০০ উট, পর দিন ১০০ দুম্বা কুরবানী করেন।

৪. তৃতীয় দিন তিনি বুঝতে পারেন, প্রিয় বস্তু হলো, হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম।

৫. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বিবি হাজেরা কে দাওয়াত খাওয়ার কথা বলে সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কে যবেহ করার জন্য নিয়ে যান।

৬. জবাইয়ের আগে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তার পিতা হযরত ইবরাহীমকে বলেন, তিনি যেন তাকে শক্ত করে বেধে নেন। যেন বাবার গায়ে হাত পা ছুটাছুটির সময় পা লেগে না যায়।

৭. ইসমাঈল আলাইহিস সালাম নাকি আরো বলেন যে, তার রক্তে মাখা জামা-কাপড়গুলো যেন তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। যেন তার মা কাপড়গুলো নিয়ে সান্ত্বনা পান।

৮. ইসমাঈল আলাইহিস সালাম আরো বলেন, তাকে কাত করে শোয়াতে। যেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার চেহারা দেখে মায়ার বশবর্তী হয়ে কুরবানী করা থেকে বিরত না হন।

৯. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বারবার ছুরি চালাচ্ছিলেন কিন্তু কিছুতেই জবাই হচ্ছিল না।

১০. আরো প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কে দড়ি দিয়ে ভাল করে বাঁধেন।

১১. বলা হয়, শয়তান প্রথমে হযরত হাজেরা আঃ কে, তারপর ইসমাঈল আঃ কে অত:পর ইবরাহীম আঃ কে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন রকমের কথা বলে বুঝাতে থাকে।

১২. আরো বলা হয়, ছুরি যখন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর গলার রগ কাটতে ছিলো না তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ছুরিটি দূরে নিক্ষেপ করলে তা পাথরের সঙ্গে লেগে পাথর দুই টুকরা হয়ে যায়।

১৩. হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যে দুম্বাটি যবেহ্ করেন তা ছিল জান্নাতে সংরক্ষিত হাবিলের কুরবানরি দুম্বা।

উপরোক্ত সবগুলো কথা বানোয়াট ও জাল ও ভিত্তিহীন। হাদীস হিসেবে এগুলো বর্ণনা করা, প্রচার করা, ওয়াজ করা জায়েয নয়।

লক্ষ করার বিষয় হলো :

১. সূরা সফফাতের ১০২ নং আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ইবরাহীম আঃ স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, ইসমাঈল আঃ কে তিনি কুরবানি করছেন। কিন্তু প্রচলিত গল্পে বলা হয় তিনি বারবার “প্রিয় বস্তু” কুরবানি করার স্বপ্ন দেখেছেন। এরপর অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বুঝতে পারেন যে ইসমাঈল আঃ কে কুরবানি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রিয় বস্তু কুরবানীর বিষয়টি কুরআনের এই আয়াতের বিরুদ্ধে যায়।

এই “প্রিয় বস্তু কুরবানীর” মিথ্যাকে কেন্দ্র করে কিছু অতি উৎসাহী মানুষ বলে থাকে হাট থেকে কেনা গরু ছাগলে কুরবানী হয় না। কারণ সেগুলো নিজের পালা পশু না। নিজে পাললে তার প্রতি মায়া জন্মে। এজন্য এগুলো দিয়ে কুরবানী হবে না। একটা বানোয়াট কথার উপর ভিত্তি করে আরেকটা বানোয়াট কথার উদ্ভব। আল্লাহ এসব মিথ্যা ও বানোয়াট কথা থেকে মুসলিমদের রক্ষা করুন।

২. গল্পে বলা হয়েছে ইবরাহীম আঃ তার স্ত্রীকে বলেছিলেন “ছেলেকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়ার জন্য। কারণ হিসাবে বলা হয় দাওয়াত খেতে যাবেন বা বেড়াতে যাবেন”। নাউযুবিল্লাহ! আল্লাহর একজন নবী ইবরাহীম আঃ মিথ্যা কথা বলে আল্লাহর একটি নির্দেশ পালন করবেন!!! নাউযুবিল্লাহ!

যেই ওয়াজেয়ীনগণ বা সমাজে যারা এ গল্প প্রচার করেন তারা সরাসরি একজন নবীকে মিথ্যাবাদী বানিয়ে দিচ্ছেন! আল্লাহ মাফ করুন। কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে,

“ইব্রাহিম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কী? সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। (সূরা সফফাত ১০২)”

এখানে পিতা-পুত্র দুইজনই আল্লাহর নবী। পিতা সরাসরি পুত্রকে আল্লাহর আদেশের কথা বলেছেন। পুত্রও সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করার জন্য। সেখানে আমরা মিথ্যাচার করে বানোয়াট গল্প প্রচার করে থাকি। নাঊযুবিল্লাহ্।

৩. হাত-পা বাধা বা কাত করে শোয়ানোর ব্যাপারে বলা হয় ইসমাঈল আঃ কাত করে শোয়াতে বলেছিলেন। যেন ইসমাঈলের আঃ চেহারা দেখে মায়া জন্মে ইবরাহীম আঃ কুরবানী থেকে ফিরে না আসে। এটাও ভিত্তিহীন কথা। কুরআনের বাণী থেকে জানতে পারি ইবরাহীম আঃ কাত করে ইসমাঈলকে আঃ শুইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামাঈল আঃ এমন কথা বলেছিলেন এটা কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।

গল্পের এই কথা দ্বারাও নবীর প্রতি বেয়াদবী হয়। কারণ এখানে সংশয় প্রকাশের অবকাশ তৈরি করা হয় যে, ইবরাহীম আঃ তার পুত্রের মায়ায় আল্লাহর হুকুম থেকে যেন ফিরে না আসেন। এটা খুবই অন্যায় কথা।

৪. গল্পে বলা হয় ইসমাঈল আঃ তার রক্তাক্ত জামা-কাপড় তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। যেন তার মা হাজেরা আঃ সেই কাপড়গুলো নিয়ে সান্ত্বনা পান। এ কথাও কুরআন বা হাদীস থেকে পাওয়া যায় না। গল্পকারদের মস্তিষ্ক প্রসূত এসব কথা তাই বিশ্বাস করা বা প্রচার করা যাবে না।

৫۔ হাবিলের দুম্বা কুরবানী হওয়া প্রসঙ্গে একটি হাদীস পাওয়া যায় কিন্তু তা সহীহ্ নয় বরং মুনকার তথা জাল। এজন্যই হাফেয ইবনে কাছীর রহ۔ বলেন,

والصحيح الذي عليه الأكثرون أنه فُدي بكبش

অর্থাৎ, সহীহ্ কথা হলো, কুরবানী একটি দুম্বা হয়েছে। (কিন্তু কোন্ দুম্বা তা নির্দিষ্ট নয়।) -তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা সাফফাত: ১০৭

কুরবানী সংক্রান্ত অনেক কথা বা ঘটনা ইহুদীদের বা ইসরাঈলী রেওয়ায়েত থেকে পাওয়া যেতে পারে। সেগুলোর মধ্যে যে কথাগুলো কুরআন-হাদীসের সাথে মিলে যায়, আমরা সেগুলো সেখান থেকে গ্রহণ করব। আর যে কথাগুলোর সত্যতার ব্যাপারে কুরআন-হাদীসের কোনো দলীল পাব না সেগুলোকে গ্রহণ করব না।

ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস নিয়ে জাল বর্ণনা; খোন্দকার আব্দুল্লাহ্ জাহাঙ্গির রহ. এর বক্তব্য

অনেক মিথ্যা ও কুরআন-হাদীসের বর্ণনার বিপরীত কথা হাদীস ও তাফসীর হিসাবে প্রচলিত। কয়েকটি বিষয়ের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি :

(ক) কুরআন কারীমে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম আঃ তার পুত্রকে জবাই করতে স্বপ্নে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম আঃ স্বপ্নে দেখেন যে, ‘তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্তকে কুরবানী কর।’ এ কথাটি ভিত্তিহীন; কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে এরূপ কথা বর্ণিত হয় নি।

(খ) কুরআনে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবরাহীম আঃ তাঁর পুত্রকে জানান যে, তিনি তাঁকে জবাই করার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম আঃ তাঁর স্ত্রীকে ও পুত্রকে দাওয়াত খাওয়া… ইত্যাদি মিথ্যা কথা বলে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যান। … সর্বশেষ তিনি পুত্রকে সত্য কথাটি জানান। এ সকল কথা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয় নি। এ ছাড়া এই কথাগুলো নবীগণের মর্যাদার খেলাফ। আল্লাহর খলীল তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে কেন মিথ্যা কথা বলবেন?

(গ) প্রচলিত আছে যে, ইবরাহীম আঃ পুত্র ইসমাঈলকে দড়ি দিয়ে ভাল করে বাঁধেন। এরপর শুইয়ে তাঁর গলায় বারংবার ছুরি চালান….। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। কুরআনে তো সুস্পষ্টই বলা হচ্ছে যে, জবাই করার প্রস্ত্ততি নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান এসে যায়। কোনো ছুরি চালানোর ঘটনা ঘটে নি। হাদীস শরীফেও বর্ণিত হয়েছে যে, জবাইয়ের প্রস্ত্ততি নেওয়ার সময়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিকল্প জানোয়ার প্রদান করা হয়।

এ বিষয়ে ত্রয়োদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ সিরিয় মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২৭৬হি.) বলেন, ইবরাহীম আঃ এর বিষয়ে যে গল্প প্রচলিত আছে যে, তিনি তাঁর পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন, কিন্তু কাটে নি… এ গল্পটি জাল, মিথ্যা এবং যিন্দীকদের বানানো…। –হাদীসের নামে জালিয়াতি পৃ. ২৯৫-২৯৬

ইবরাহিম নবীর ঘটনা আল কাউসার

মারকাযুদ দাওয়াহ্ আল-ইসলামিয়া এর মুখপাত্র মাসিক আল কাউসার পত্রিকাতেও এগুলোকে ভ্রান্ত বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে কোন বর্ণনাই নেই। বরং বানোয়াট কিসসা। এখানে ক্লিক করে পড়ে নিন,

একটি বানোয়াট কিসসা : ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কি ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও তার মাকে দাওয়াত খাওয়ার কথা বলে নিয়ে যান?

শয়তানকে পাথর মারা হয় কেন

আমাদের সমাজে হজ্বের মধ্যে শয়তান কে পাথর মারা নিয়ে ভুল কথা বা ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এটাও হযরত ইবরাহিম আঃ এর কোরবানীর ইতিহাস সম্পর্কীয় তাই এই বিষয়টি আলোচনা করতে চাই।

মিনার তিন জামরা কি তিন শয়তান?

‘জামরাত’ আরবী ‘জামরাতুন’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হচ্ছে ছোট ছোট কংকর বা নুড়ি পাথর। যেহেতু মিনার তিনটি জামরাতে ছোট ছোট কংকর নিক্ষেপ করা হয় এজন্য এগুলোকে ‘জামরাত’ বলে। অনেকে ধারণা করে যে, তিন ‘জামরা’ হল তিন শয়তান কিংবা প্রত্যেক জামরার সাথে একটি করে শয়তান বাঁধা আছে। অনেকে আবার বলে, প্রথমটি হচ্ছে বড় শয়তান। তার পরেরটা মেঝ শয়তান। তার পরেরটা ছোট শয়তান।

মনে রাখবেন, এসব ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এখানে কোন শয়তান বাধা নেই। আসলে এই নুড়ি বা কংকর নিক্ষেপের প্রেক্ষাপট হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়।

عن ابن عباس قال جاء جبريل إلى رسول الله صلى الله عليه و سلم فذهب به ليريه المناسك فانفرج له ثبير فدخل منى فأراه الجمار ثم أراه عرفات فتتبع الشيطان لنبي صلى الله عليه و سلم عند الجمرة فرما بسبع حصيات حتى ساخ ثم تبع له في الجمرة الثانية فرماه بسبع حصيات حتى ساخ ثم تبع له في جمرة العقبة فرماه بسبع حصيات حتى ساخ فذهب. صحيح ابن خزيمة: 2967. قال الشيخ مصطفى الأعظمي : إسناده ضعيف، قال الهيثمي 3 / 260 : رواه الطبراني في الكبير وفيه عطاء بن السائب قد اختلط

হযরত ইবরাহীম আ. যখন আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে হযরত ইসমাইল আঃ কে কুরবানী করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন শয়তান তিনবার তাঁকে ফিরানোর চেষ্টা করেছিল। আর তিনবারই ইবরাহীম আঃ তাকে সাতটি করে কংকর নিক্ষেপ করে প্রতিহত করেছিলেন। অবশেষে তিনি এই মহাপরীক্ষায় কামিয়াব হয়েছেন। যে তিন স্থানে ইবলিস তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সেই তিন স্থান নিশানার মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে সেখানে একটি করে খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে যে খুঁটিটি মক্কার সীমানার একেবারেই নিকটবর্তী এবং মসজিদে খাইফ থেকে দূরে অবস্থিত সেটাকে ‘আলজামরাতুল কুবরা’ বা ‘জামরাতুল আকাবা’ বলে। এর পরেরটিকে ‘আলজামরাতুল উসতা’ এবং এর পরেরটিকে ‘আলজামরাতুল উলা’ বা ‘আলজামরাতুদ দুনইয়া’ (নিকটতম জামরা) বলে।

হযরত ইবরাহীম আঃ সরাসরি শয়তানকেই কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন। আজ তাঁর অনুসরণে ওই সকল স্থানে কংকর নিক্ষেপ করা হয় যেখানে যেখানে শয়তান তাঁকে বাধা দিয়েছিল আর তিনি কংকর মেরে ওকে প্রতিহত করেছিলেন। আমাদের কংকর নিক্ষেপের উদ্দেশ্য হল, হযরত ইবরাহীম আঃ এর অনুকরণ ও অনুসরণ।

বাস্তবে না সেখানে শয়তান থাকে আর না শয়তান সেখানে বাঁধা থাকে। এটা কেবলই আমাদের মিল্লাতে হানীফ, মিল্লাতে তাওহীদের ইমাম হযরত ইবরাহীম আঃ এর আমলের অনুসরণ। এতেই মুমিনের তৃপ্তি মিলে ও ঈমার বাড়ে। তাই এখানে ছেড়া জুতা নয়, বরং মিল্লাতে ইবরাহীমীর অনুকরণে কংকর মারাই হবে ঈমান ও ইসলামের মূল দাবি।

মোটকথা, মিনার ‘জামারাত’ শয়তান নয় এবং শয়তান সেখানে খুঁটির আকৃতিতে উপস্থিতও নয় আর শয়তানকে সেখানে বেঁধেও রাখা হয়নি। বরং আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালনার্থে সেখানে কংকর নিক্ষেপ করা হয়।

তাকবীরে তাশরীক কি হযরত ইবরাহীম আঃ এর দুম্বা কুরবানী থেকে এসেছে?

বলা হয়ে থাকে যে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে যবেহ করার জন্য ছুরি চালাচ্ছিলেন তখন হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম দুম্বা এনে দূর থেকে দেখতে পেলেন যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম খুব তাড়াহুড়া করছেন। এ দেখে জিবরীল আমীন মনে করলেন এই বুঝি ইসমাইল আলাইহিস সলাম যবেহ হয়ে গেল।

তাই তিনি দূর থেকেই বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’। শুনে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ আর দুম্বা যবেহ হতে দেখে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম বলে উঠলেন, ‘ওয়াল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ’।

এই গল্পটিও সহীহ্ নয়। বরং এটিও একটি বানোয়াট কিসসা

এই গল্পটি কোন হাদীসের কিতাবে বর্ণিত হয়নি। বানোয়াট কিসসা-কাহিনীর অন্যতম এটি একটি। কে বা কারা এটি তৈরী করেছে আল্লাহই ভালো জানেন। ফিক্বহের ইমাম স্বয়ং ইবনে আবেদীন রহ. পর্যন্ত বলেছেন, মুহাদ্দিসীনে কেরামগণের নিকট এই গল্পটি প্রমাণিত নয়। -ফাতাওয়ায়ে শামী ৩/৫৮ (মাকতাবায়ে আশরাফিয়া); তাতারখানিয়া ২/৬৩৮; এসব হাদীস নয় (২) পৃ. ১০৩-১০৪

আহলে সালাফ মডিয়িা সার্ভিসের সাথে থাকার জন্য অসংখ্য জাযাকাল্লাহ্

Check Also

রোযা ও তারাবীর মাসায়েল

রোযা ও তারাবীর মাসায়েল জানা আমাদের সবার জন্যই জরুরী।  যাতে করে আমাদের সকলের রোযাগুলো সহীহ্ …

আপনি কিভাবে তালাক দিবেন?

আপনি কিভাবে তালাক দিবেন? প্রবন্ধটি তালাকের ক্ষেত্রে একটি সহজ সরল উপস্থাপন। এতে একজন স্বামী তার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!