হোম / আকিদা-বিশ্বাস / কবরের আজাব ও প্রশ্নোত্তর

কবরের আজাব ও প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন:

কবরের আজাব ও প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে আমার কয়েকটি বিষয় জানার আছে। বিষয়গুলো হলো : 

১. আমরা জানি কবরে মৃত ব্যক্তির প্রশ্নোত্তর হয়। কিন্তু যারা আগুনে পুড়ে মারা যায় কিংবা পানিতে ডুবে মারা যায় অথবা বাঘে খেয়ে নেয়, তাদের প্রশ্নোত্তর কোথায় হবে?

২. কবরে মানুষকে কবরের মাটি দু‘পাশ থেকে চাপ দেয়, কথা কি সিঠিক?

৩. সাধরাণত আমরা দেখি, আগে হিসাব হয় তারপর শাস্তি হয়। কিন্তু কবরে তো মানুষের হিসাবের পূর্বেই শাস্তি দেয়া হচ্ছে!

নিবেদক

রমাযান আলী

উত্তর :

কবরের আজাব ও প্রশ্নোত্তর

কবরের আজাব ও প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর নিম্নে ধারাবাহিক উল্লেখ করা হলো।

১. মৃত ব্যক্তির প্রশ্নোত্তর শুধু কবরেই হবে এ ধারণাটি সঠিক নয়। বরং মানুষের মৃত্যুর পর রুহ যেখানে থাকবে সেখানেই প্রশ্নোত্তর হবে। সেটা মাটির কবর হোক কিংবা অন্যত্র। কবরের জগতকে আলমে বরযখ বলে। যা মানুষের মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময়কে বুঝায়। কুরআন-হাদীসে কবর জীবন সম্পর্কে আমাদের কে যা অবহিত করা হয়েছে তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নেয়াই হবে ঈমান বিল গায়েবের দাবি।

সুনিশ্চিত কথা হলো, প্রতিটি মানুষকেই প্রশ্নোত্তরের সম্মুখীন হতে হবে। কিছু হাদীসে প্রশ্নোত্তরের বিশেষ কিছু পদ্ধতিও বর্ণিত হয়েছে। -আবু দাউদ ৪৭৫৩; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৫০-৫৩

তবে আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করলে, পানিতে ডুবে মারা গেলে তার প্রশ্নোত্তর কিভাবে হবে তা আল্লাহ্ তায়ালাই ভালো জানেন। এ সংশয় হওয়া উচিত নয় যে, মানুষের শরীর না থাকলে তার প্রশ্নোত্তর হওয়াটা দুস্কর। কারণ এই প্রশ্নোত্তরগুলো আলমে বরযখে ব্যক্তির রুহের সাথে সংঘটিত হয়। শরীর কেবল তার অনুগামী মাত্র। এমনকি আল্লাহ্ তায়ালা চাইলে ব্যক্তির রুহের সাথে তার শরীরকেও মুহূর্তের মধ্যে একাকার করে দিতে পারেন। যেমনটি সহীহ্ বুখারীর হাদীস থেকে জানা যায়। -বুখারী ৬৪৮০, ৬৪৮১

২. কবরের মাটি মৃত ব্যক্তি কে কবরে চাপ দেওয়ার যে কথাটি শোনা যায় তা সঠিক। আবু দাউদ শরীফের এক দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কাফেরের কবর তার জন্য এতই সংকুচিত হয়ে যাবে যে, তার পাজরের এক পাশ অপর পাশে চলে যাবে। -আবু দাউদ ৪৭৫৩

কবরের চাপ থেকে কেউই রেহাই পাবে না। -মুসনাদে আহমদ ২৪৬৬৩

তবে মুমিনের জন্য এই চাপ হবে মা তাঁর সন্তানের সাথে স্নেহমাখা মোয়ানাকার ন্যায়। অত:পর কবর কে তার জন্য দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করে দেয়া হবে। -শরহে ফিক্বহে আকবার পৃ. ১৭২, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৪৯-৫০

৩. কবরে যে শাস্তি মৃত ব্যক্তি কে দেয়া হয় তার সম্পর্কে একথা বলা সঠিক নয় যে, হিসাব-নিকাশের পূর্বেই তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কারণ, কবরে তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, মুনকার-নাকিরের প্রশ্নের উত্তর প্রদানে অক্ষম হওয়ার কারণে। তো এটা একটি পরীক্ষা, যাতে উত্তীর্ণ না হলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। অসংখ্য হাদিসে এটি বর্ণিত হয়েছে। -আবু দাউদ ৪৭৫৩; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৫৩

এটি কবরের জগতের শাস্তি। আর পরকালে যে শাস্তির কথা এসেছে সেটি পুনরুত্থানের পর হবে। পরকাল ও কবরের জীবন দুটি ভিন্ন জগত। উভয় জগতের শাস্তি ও শান্তি এক নয়। তিরমিযী শরীফের একটি হাদীসে এসেছে,

কবর হলো আখেরাতের ঘাটি সমূহ থেকে প্রথম ঘাটি। এই ঘাটির পরীক্ষায় যদি কেউ উত্তীর্ণ হয়ে যায় তাহলে তার জন্য পরবর্তী ঘাটিগুলো পার হওয়া সহজ হয়ে যাবে। আর যদি উত্তীর্ণ না হতে পারে তাহলে (এখানে শাস্তি ভোগ করবে আর) পরবর্তী ঘাটিগুলো পার হওয়া তার চেয়েও কঠিন হয়ে যাবে। -তিরমিযী ২৩০৮; ইবনে মাজাহ ৪২৬৭; মুসনাদে আহমদ ৪৫৪

কবরের আজাব কি সত্য?

 زَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ قَالَ بَيْنَمَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فِي حَائِطٍ لِبَنِي النَّجَّارِ عَلَى بَغْلَةٍ لَهُ وَنَحْنُ مَعَهُ إِذْ حَادَتْ بِهِ فَكَادَتْ تُلْقِيهِ وَإِذَا أَقْبُرٌ سِتَّةٌ أَوْ خَمْسَةٌ أَوْ أَرْبَعَةٌ – قَالَ كَذَا كَانَ يَقُولُ الْجُرَيْرِيُّ – فَقَالَ ‏”‏ مَنْ يَعْرِفُ أَصْحَابَ هَذِهِ الأَقْبُرِ ‏”‏ ‏.‏ فَقَالَ رَجُلٌ أَنَا ‏.‏ قَالَ ‏”‏ فَمَتَى مَاتَ هَؤُلاَءِ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ مَاتُوا فِي الإِشْرَاكِ ‏.‏ فَقَالَ ‏”‏ إِنَّ هَذِهِ الأُمَّةَ تُبْتَلَى فِي قُبُورِهَا فَلَوْلاَ أَنْ لاَ تَدَافَنُوا لَدَعَوْتُ اللَّهَ أَنْ يُسْمِعَكُمْ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ الَّذِي أَسْمَعُ مِنْهُ ‏”‏ ‏.‏

ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ فَقَالَ ‏”‏ تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ النَّارِ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ النَّارِ فَقَالَ ‏”‏ تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنَ الْفِتَنِ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الْفِتَنِ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ قَالَ ‏”‏ تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ فِتْنَةِ الدَّجَّالِ ‏”‏ ‏.‏ قَالُوا نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ فِتْنَةِ الدَّجَّالِ ‏.‏

যায়দ ইবনু সাবিত (রাযিঃ) এর সূত্রে আবু সাঈদ আল খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। আবু সাঈদ আল খুদরী (রাযিঃ) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে উপস্থিত ছিলাম না, বরং আমাকে যায়দ ইবনু সাবিত (রাযিঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজ্জার গোত্রের একটি প্রাচীর ঘেরা বাগানে তার একটি খচ্চরের উপর আরোহী ছিলেন। এ সময় আমরা তার সাথে ছিলাম।

অকস্মাৎ তা লাফিয়ে উঠল এবং তাকে ফেলে দেয়ার উপক্রম করল। দেখা গেল, সেখানে ছয়টি কিংবা পাঁচটি অথবা চারটি কবর রয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, জুরাইরী এমনটিই বর্ণনা করতেন। অতঃপর তিনি প্রশ্ন করলেন, এ কবরবাসীদেরকে কে চিনে? তখন এক ব্যক্তি বললেন, আমি চিনি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তারা কখন মৃত্যুবরণ করেছে? তিনি বললেন, তারা শিরকের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।

অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ উম্মাতকে তাদের কবরের মধ্যে পরীক্ষা করা হবে। তোমরা মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা বর্জন করবে, এ আশঙ্কা না হলে আমি আল্লাহর নিকট দু’আ করতাম যেন তিনি তোমাদেরকেও কবরের আযাব শুনান যা আমি শুনতে পাচ্ছি।

তারপর তিনি আমাদের প্রতি মনোনিবেশ করে বললেন, তোমরা সবাই জাহান্নামের আযাব হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো। সাহাবাগণ বললেন, জাহান্নামের শাস্তি হতে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। তারপর তিনি বললেন, তোমরা সকলে কবরের শাস্তি হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো।

সাহাবাগণ বললেন, কবরের আযাব হতে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার ফিতনাহ হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো। তারা বললেন, প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার ফিতনাহ্ হতে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। তিনি আবারো বললেন, তোমরা দাজ্জালের ফিতনাহ হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও। সাহাবাগণ বললেন, দাজ্জালের ফিতনাহ হতে আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। -মুসলিম ২৮৬৭

তথ্যসূত্র

-সহীহ্ বুখারী ৬৪৮০, ৬৪৮১; আবু দাউদ ৪৭৫৩; মুসনাদে আহমদ ২৪৬৬৩, ২৩৩৫৩, ২৪২৮৩; তিরমিযী ২৩০৮; মুসলিম ২৭৫৭; নাসায়ী ২০৭৯, ২০৮০; ইবনে মাজাহ ৪২৬৭; শরহু মুশকিলিল আছার ২৭৩; মুসনাদুল বাযযার ৫০৩; শুআবুল ঈমান ৩৯৮; সুনানে কুবরা বাইহাকী ৭১৪৫

মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৫৩-৫৭, ৩/৪৯-৫০; শরহে ফিক্বহে আকবার (মুল্লা আলী কারী) পৃ. ১৭১-১৭২; শরহুল আকিদাতিত তহাবিয়্যাহ্ ২/৬১০-৬১১; কিতাবুর রুহ পৃ. ১৮১, ২০১-২০২; আত-তাওযীহাতুল জালিয়্যাহ্ আলা শরহিল আকিদাতিত তহাবিয়্যাহ্ (ড. খামীস) ৩/১০২৯, ১০৩৫

মিরকাতুল মাফাতিহ ১/৩১০; উমদাতুল কারী ১১/২৩২-২৩৩ (দারুল ফিকির); ফাতহুল বারি ৬/৫৮৮-৫৮৯ (দারুল হাদীস); হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ্ ১/১৩১-১৩৮; মাআরিফুল হাদীস ১/১২৬; ইনআমুল বারি ৮/২৬২; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ ১৮/৭৮; আঁপকে মাসয়েল আওর উনকা হল ২/৪২০-৪২১

কিতাবুন নাওয়াযেল ১/৩১৭-৩১৮; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ৩/৩৭২-৩৭৫; আহকামে ইসলাম আকল কি নযর মেঁ পৃ. ৩৫০; আশরাফুল জাওয়াব পৃ. ৫৫৬; কিতাবুল ফাতাওয়া ১/৩৬৪-৩৬৭, ২৩৭-২৩৮

আহলে সালাফ মিডিয়া সার্ভিসের সাথে থাকার জন্য অসংখ্য জাযাকাল্লাহ্

Check Also

রোযা ও তারাবীর মাসায়েল

রোযা ও তারাবীর মাসায়েল জানা আমাদের সবার জন্যই জরুরী।  যাতে করে আমাদের সকলের রোযাগুলো সহীহ্ …

আপনি কিভাবে তালাক দিবেন?

আপনি কিভাবে তালাক দিবেন? প্রবন্ধটি তালাকের ক্ষেত্রে একটি সহজ সরল উপস্থাপন। এতে একজন স্বামী তার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!