আশুরার ঘটনা : জাল বর্ণনা থেকে বাঁচুন

প্রশ্ন:

আশুরার ঘটনা : জাল বর্ণনা থেকে বাঁচুন। আমাদের সমাজে আশুরার দিন সম্পর্কীয় অনেক ঘটনার প্রচলন রয়েছে। অসংখ্য ঘটনা এ দিনে ঘটেছে বলে মসজিদের খতিব সাহেবদের থেকে শুরু করে অনেকেরে মুখে শোনা যায়। আমার জানার বিষয় হলো, এ দিনে কোন্ কোন্ ঘটনা ঘটোছে? কুরআন-হাদীসের আলোকে যদি জানাতেন উপকৃত হতাম।

যোবায়ের হাসান

উত্তর :

আশুরার ঘটনা : জাল বর্ণনা থেকে বাঁচুন

লোক সমাজে এ দিনের অসংখ্য ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। আলোচনার শেষের দিকে আমরা এ বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করব ইনশাআল্লা্হ্। আমাদের দায়িত্ব হলো এ সম্পর্কীয় জাল বর্ণনা বা অত্যাধিক দুর্বল বর্ণনা পরিহার করা।

আশুরার দিনে কি কি ঘটেছে?

সহীহ্ হাদীস সমূহে আশুরার দিনের কিছু ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া অসংখ্য ঘটনা এমন রয়েছে যেগুলোর সাথে আশুরার দিনের কোন সম্পর্ক নেই।

আশুরা অর্থ কি

আশুরা অর্থ দশম। মহাররম মাসের দশম তারীখকে আশুরা বলা হয়। একারণেই বলা হয় আশুরার দিন বা মহাররম মাসের দশ তারীখ।

আশুরা সম্পর্কে হাদীস

আশুরা সম্পর্কীয় হাদীসগুলো হাদীসের কিতাব সমূহে ‘সাওমে ইয়াওমে আশুরা’ শিরোনামে রয়েছে। সামনের আলোচনায় কিছু আসছে ইনশাআল্লাহ্।

পবিত্র আশুরার ইতিহাস

পবিত্র আশুরার ইতিহাস, মহররমের ইতিহাস, ১০ মহররমের ইতিহাস, আশুরার ফজিলত বা মহররম মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সবগুলো কাছাকাছি বিষয়। সার কথা হলো, এ দিনে আল্লাহ্ তায়ালা হযরত মুসা আলাইহিস সালাম কে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। ব্যস! এটুকুই। এছাড়া এ দিনের আর কোন ইতিহাস নেই।

কারবালা ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত কেন

কারবালা ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত কেন এর উত্তর সোজা। কারবালার প্রান্তরে হযরত হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু মর্মান্তিকভাবে শাহাদাহ বরণ করেছেন। সেটি আশুরার দিনে হওয়া একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। তাঁর শাহাদাতের কারণে আশুরার দিন মর্যাদাপূর্ণ হয়ে যায়নি। দিন বা রাত ফজিলতপূর্ণ হয় কুরআন-হাদীসের আলোকে। কোন ঘটনা চক্রের কারণে নয়। এ দিন আরো কত ঘটনাই ঘটতে পারে। তাই বলে আশুরার দিন আরো ফজিলতপূর্ণ হয়ে যাবে ব্যাপারটি এমন নয়।

দশ মুহাররম ‘ইয়াওমে আশুরা’ : গুরুত্ব ফযীলত এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانُوا يَصُومُونَ عَاشُورَاءَ قَبْلَ أَنْ يُفْرَضَ رَمَضَانُ وَكَانَ يَوْمًا تُسْتَرُ فِيهِ الْكَعْبَةُ فَلَمَّا فَرَضَ اللهُ رَمَضَانَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ شَاءَ أَنْ يَصُومَهُ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ شَاءَ أَنْ يَتْرُكَهُ فَلْيَتْرُكْهُ

‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমাযানের সওম ফরজ হওয়ার পূর্বে মুসলিমগণ ‘আশূরার সওম পালন করতেন। সে দিনই কা‘বা ঘর (গিলাফে) আবৃত করা হতো। অতঃপর আল্লাহ যখন রমাযানের সওম ফরজ করলেন, তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আশূরার সওম যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা সে ছেড়ে দিবে। বুখারী ১৫৯২

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ لَمَّا قَدِمَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْمَدِيْنَةَ وَجَدَ الْيَهُوْدَ يَصُومُوْنَ عَاشُوْرَاءَ فَسُئِلُوْا عَنْ ذَلِكَ فَقَالُوْا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِيْ أَظْفَرَ اللهُ فِيْهِ مُوْسَى وَبَنِيْ إِسْرَائِيْلَ عَلَى فِرْعَوْنَ وَنَحْنُ نَصُومُهُ تَعْظِيْمًا لَهُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَحْنُ أَوْلَى بِمُوْسَى مِنْكُمْ ثُمَّ أَمَرَ بِصَوْمِهِ

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনা্য় আসেন তখন দেখতে পেলেন ইয়াহূদীরা ‘আশুরা দিবসে সাওম পালন করে। তাদেরকে সাওম পালনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এদিনই আল্লাহ্ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও বনী ইসরাঈলকে ফিরাউনের উপর বিজয় দিয়েছিলেন। তাই আমরা ঐ দিনের সম্মানে সাওম পালন করি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা (আঃ)-এর বেশি নিকটবর্তী। এরপর তিনি সাওম পালনের নির্দেশ দিলেন। -বুখারী ৩৯৪৩

এ দিনের রোযার ফযীলতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ.

আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি, তিনি পূর্বের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখতে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত  নারী সাহাবী হযরত রুবায়্যি‘ বিনতে মুআববিয রা. বলেন,

عَنْ الرُّبَيِّعِ بِنْتِ مُعَوِّذٍ قَالَتْ أَرْسَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَدَاةَ عَاشُورَاءَ إِلَى قُرَى الْأَنْصَارِ مَنْ أَصْبَحَ مُفْطِرًا فَلْيُتِمَّ بَقِيَّةَ يَوْمِهِ وَمَنْ أَصْبَحَ صَائِمًا فَليَصُمْ قَالَتْ فَكُنَّا نَصُومُهُ بَعْدُ وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا وَنَجْعَلُ لَهُمْ اللُّعْبَةَ مِنْ الْعِهْنِ فَإِذَا بَكَى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهُ ذَاكَ حَتَّى يَكُونَ عِنْدَ الْإِفْطَارِ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ খবর পাঠালেন- যে আজ সকালে খেয়েছে সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন রোযা পূর্ণ করে। ঐ নারী সাহাবী বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তার সময় কেটে যেত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬০

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার রোযা রাখছিলেন এবং অন্যদেরকে রোযা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবীগণ বললেন-

يَا رَسُولَ اللهِ إِنّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنّصَارَى؟

ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ দিনকে তো ইহুদী-নাসারারা (খ্রিস্টানরা) সম্মান করে? তখন নবীজী বললেন-

فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التّاسِعَ قَالَ: فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ، حَتّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.

তাহলে আগামী বছর আমরা নয় তারিখেও রোযা রাখব- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সেই আগামী বছর আসার পূর্বেই নবীজীর ইন্তেকাল হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৪

এসব হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম :

১. রমযানের রোযা ফরয হওয়ার আগে সাহাবায়ে কেরাম আশুরার রোযা রাখতেন। অর্থাৎ, রমযানের আগে আশুরার রোযা ফরয ছিল। আশুরার দিনটি মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় আশুরার দিনে কাবা শরীফে গিলাফ চরানো হতো। তাই বুঝা গেল কারবালার ঘটনার কারণে আশুরার দিনের মর্যাদা হয়নি।

২. আশুরার দিনের মর্যাদা হয়েছে, কারণ, এ দিনে ফেরাউনকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে এবং হযরত মুসা আলাইহিস সালাম কে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন।

৩. হাদীসগুলো থেকে আশুরার দিনের ইতিহাস স্পষ্ট হয়েছে।

৪. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম আশুরার দিনে রোযা রাখতেন।

৫. আশুরার রোযা ইহুদীদের বিরুদ্ধাচরণ করে দুইটা রাখতে বলা হয়েছে। এটা ৯ ও ১০ মুহাররম দুই দিন। সাথে ১১ মুহাররম সহ মোট তিন দিন রোযা রাখলে আরো ভালো হয়। কারণ, পুরা মুহাররম মাসই ‍যত বেশি রোযা রাখা যায়। 

৬. বাচ্চারাও আশুরার রোযা রাখত।

আশুরার দিনের ঘটনা

আশুরার দিনের ঘটনা বা আশুরার দিনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

১. হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাথীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা; যেখানে দরিয়ায় রাস্তা বানিয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন।

২. এই রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় ফেরাউন ও তার সৈন্যদেরকে দরিয়ায় ডুবিয়ে ধ্বংস করার ঘটনা।

عن ابن عباس رضي الله عنه قال قدم رسول الله صلى الله عليه و سلم المدينة فوجد اليهود يصومون يوم عاشوراء فسئلوا عن ذلك ؟ فقالوا هذا اليوم الذي أظهر الله فيه موسى وبني إسرائيل على فرعون فنحن نصومه تعظيما له فقال النبي صلى الله عليه و سلم نحن أولى بموسى منكم فأمر بصومه

-সহীহ্ মুসলিম ১১৩০

এছাড়া আশুরার দিনের আর কোন ঘটনা সহীহ্ নয়। যেমন আশুরার দিনে কেয়ামত হবে মর্মে বর্ণিত হাদীস জাল। আশুরার দিনেই হযরত আদম আলাইহিস সালামের তাওবা কবুল হয়েছে মর্মে হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল। আর কিছু সুত্র আছে জাল। অবশ্য কোন কোন তাবেযী থেকে এমন কথা পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি মারফূ হাদীস নয়, বরং তাদের নিজস্ব বক্তব্য। -লাতাইফুল মাআরিফ ১১৩-১১৫

হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কিশতী আশুরার দিনে জূদী পাহাড়ে থেমেছিল মর্মের বর্ণনাটিও খুবই দুর্বল। দেখুন- মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮৭১৭ (শায়েখ শুয়াইব আরনাউতকৃত হাশিয়াযুক্ত নুসখা।)

ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম আশুরার দিনে হয়েছে মর্মের বর্ণনাটিও খুবই দুর্বল। মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. ভিত্তিহীন বলেছেন। -ইসলাহী খুতুবাত (মুহাররম ও আশুরার হাকীকত)

আমাদের উল্লেখ করা দুইটি ঘটনা ছাড়া আশুরার দিনের আর কোন ঐতিহাসিক ঘটনা নেই। তাই ঐ সকল ঘটনাগুলো বলা এবং প্রচার করা থেকে বিরত থাকুন। আল্লাহ্ সহায় হোন। আমীন।

আহলে সালাফ মিডিয়া সার্ভিসের সাথে থাকার জন্য অসংখ্য জাযকাল্লাহ্

Check Also

রোযা ও তারাবীর মাসায়েল

রোযা ও তারাবীর মাসায়েল জানা আমাদের সবার জন্যই জরুরী।  যাতে করে আমাদের সকলের রোযাগুলো সহীহ্ …

আপনি কিভাবে তালাক দিবেন?

আপনি কিভাবে তালাক দিবেন? প্রবন্ধটি তালাকের ক্ষেত্রে একটি সহজ সরল উপস্থাপন। এতে একজন স্বামী তার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!